বাংলাদেশী শতবর্ষী নাজিম উদ্দিন খানের জীবনরহস্য!!

আমাদের কোনো ‘সিনিয়রস ডে’ নাই, জাপানে আছে। কারণ আমাদের দেশের দূষণ আর ভেজালভোগী মানুষেরা সিনিয়র হয়ে ওঠবার ফুরসৎ খুব একটা পান না। বর্তমানে ৬১ হাজার শতায়ু মানুষ নিয়ে বিশ্বে প্রথম স্থানে থাকা জাপানে প্রতি বছর নানা আয়োজনে ১৫ সেপ্টেম্বর ‘সিনিয়রস ডে’ পালন করা হয়।


আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, বার্ধক্যের কারণে আসলে মানুষের মৃত্যু হয় না। বার্ধক্যের সাথে আসা রোগের কারণে মৃত্যু হয়। আর সেই রোগকে যিনি এড়িয়ে চলতে পারেন তিনিই আসলে শতবর্ষী হতে পারেন। ইংল্যান্ড ও জাপানের শতবর্ষী মানুষদের ওপর গবেষণা চালিয়ে মানুষের দীর্ঘদিন সুস্থ থাকার কিছু রহস্যভেদ করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এতে জানা গেছে, স্বাভাবিকের চেয়ে কম ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ হবার ঘটনা যাদের মাঝে দেখা যায়, তাদেরই আসলে ১০০ বছর পর্যন্ত সুস্থ দেহে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি।
আমরা আজ তেমনি ব্যতিক্রমী একজন সুস্থ সিনিয়র মানুষের গল্প বলব, যিনি দাবি করছেন সোয়া শতাব্দী ধরে তিনি পৃথিবীর আলো বাতাস জলের স্পর্শ পেয়ে চলেছেন। এই বয়সেও শরীরে তেমন কোনো রোগব্যাধি বাসা বাঁধেনি তাঁর। তিনি হলেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার চিনাশুখানিয়া গ্রামের শতবর্ষী নাজিম উদ্দিন খান।
চিনাশুখানিয়া গ্রামের বৃদ্ধ নাজিম উদ্দিন খানকে দেশের সবচে’ বেশি বয়স্ক মানুষ বলে দাবি করছেন তার স্বজন ও এলাকাবাসী। তবে এর সপক্ষে বিজ্ঞানভিত্তিক বা কোনো দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও ইতোমধ্যে সোয়া শ বছর পার করেছেন বলে নিজেও দাবি করেছেন ঐ বৃদ্ধ। বড় ধরণের কোনো শারীরিক অসুস্থতা না থাকায় এখনও হাঁটাচলা করতে পারেন নাজিম উদ্দিন খান। সরকারি তত্ত্বাবধানে নিরীক্ষা শেষে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের স্বীকৃতি চান বৃদ্ধের প্রতিবেশিরা।


বর্তমানে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী পৃথিবীর সবচে’ বেশি বয়স্ক মানুষ হলেন ইজরাইলের ১১২ বছর বয়সের ইজরাইল ক্রিস্টাল। অন্যদিকে বেশি বয়স্ক মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া জাপানের মিসাও ওকাওয়া ১১৭ বছর বয়সে মারা গেছেন সম্প্রতি। এমন বাস্তবতায় গাজীপুরের রাজাবাড়ি ইউনিয়নের চিনাশুখানিয়া গ্রামের বৃদ্ধ নাজিম উদ্দিন খান ও তার স্বজনরা ঐ বৃদ্ধের বয়স ১২৫ বছরের উপরে বলে দাবি করছেন। স্থানীয়ভাবে এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিদিন ঐ বয়স্ক বৃদ্ধকে দেখতে আসছেন অনেকেই। নাজিম উদ্দিনে খানের নিজের বয়সের সপক্ষে কোনো দালিলিক বা বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ না দিতে পারলেও বাংলা ১৩০৪ সনের ভয়াল ভূমিকম্পের তিনি চাক্ষুষ সাক্ষী। সেসময় তার বয়স ১০ বছরের মতো ছিল বলে তিনি জানান। এই হিসেবে বর্তমানে নাজিম উদ্দিন খানের বয়স ১২৮ বছর।

ছয় প্রজন্ম প্রত্যক্ষ করা নাজিম উদ্দিন খান প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী। তবে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের দুর্বিষহ স্মৃতি এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের ভয়াল স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেননি।
ছয় সন্তানের জনক নাজিম উদ্দিন খানের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে তিনজন ইতোমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু বড় ছেলে প্রয়াত হাবিজ উদ্দিন খানের ছেলে সামাদ খানের মেয়ের ঘরের নাতি ৬ষ্ঠ পুরুষ দেড় বছরের হিমেল আহমেদকেও চোখের সামনে দেখছেন নাজিম উদ্দিন খান। নাজিম উদ্দিন খানের ২২ নাতি নাতনির ঘরে শতাধিক সন্তান সন্ততি রয়েছে। পারিবারিক জমিজমা সংক্রান্ত ঝুটঝামেলা ছাড়া এই বেশি বয়স্ক বৃদ্ধের বড় ধরণের কোনো শারীরিক অসুস্থতাও নেই বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা। সরকারী তত্ত্বাবধানে নিরীক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের স্বীকৃতি চান বৃদ্ধ নাজিম উদ্দিন খানের স্বজন ও এলাকাবাসী।
এর আগেও নাটোরের ১৪০ বছর বয়সী ছকিনা সরকার বা মাদারীপুরের ১৫২ বছর বয়সী হাজী খাদেম শিকদারের নাম শোনা গিয়েছিল। কিন্তু স্বীকৃতি মেলেনি। এবারও সবার প্রশ্ন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়সী মানুষের স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্বরেকর্ড অর্জন করতে পারবেন তো নাজিম উদ্দিন খান?

যৌবনে দুর্দান্ত প্রতাপে নিজের ঘোড়া নিয়ে ঘোড়দৌড়ে অংশ নেয়া নাজিম উদ্দিন খানের ছেলেবেলায় স্কুল কলেজের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি। তবে নিজস্ব জীবনদর্শনে এখনও তিনি ষোলআনা টনটনে। এই দীর্ঘজীবী নাজিম খান বলেন, মানুষের জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাই পৃথিবীতে ক’দিনের অতিথি মানুষের মুক্তির জন্য নিজের ধর্মাচার পালনের সাথে এক আধ্যাত্মিক সাধনার কথা বলে যান তিনি। বাড়ি ছাড়েন ঘর ছাড়েন, ছাড়েন বিবি বাচ্চা, মরার আগে মরে যান, যদি বাঁচতে চান। নাজিম উদ্দিন খানের দর্শন আমাদেরকে মধুসূদন দত্তের কথাই মনে করিয়ে দেয়ঃ
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?
আবার বিজ্ঞানীদের কথায় ফিরে যাই। প্রশ্ন হতে পারে, সাধারণ একজন মানুষ কি নাজিম উদ্দিন খানের মতো শতবর্ষী হবার আশা করতে পারে? উত্তর হবে হ্যাঁ। এমন খাদ্যভ্যাস গড়ে তুলতে হবে যাতে এই নশ্বর শরীরে ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহের প্রবণতা কমে যায়। হোল গ্রেইন এবং টাটকা খাবার খাওয়া, ব্যায়াম করা, সুস্থ থাকার চর্চা করা এ সবই আপনাকে মেনে চলতে হবে। এর পাশাপাশি চিনি, প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে, অনিদ্রা এবং স্ট্রেসকে রাখতে হবে শতহস্ত দূরে।
আমাদের গল্পের নাজিম উদ্দিন খানও তাঁর দীর্ঘজীবনে মিষ্টি খাবার এড়িয়ে চলেছেন। প্রক্রিয়াজাত খাবার তিনি চোখে দেখেননি। মিষ্টির স্বাদ বলতে নিজেদের আখ ক্ষেত থেকে পাওয়া একটু আধটু রঙিন গুড় চেখে দেখেছেন। নিজেদের গাভি থাকায় মায়ের জীবদ্দশায় পুত্রকে তিনবেলা দুধ খাইয়েছেন। আর ভাওয়াল গড় সংলগ্ন নিজেদের এলাকায় প্রচুর আম কাঁঠাল হতো বলে বাঁধাহীন ফলের আস্বাদ পেয়েছেন তিনি। শিশুকাল ও যৌবনে পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী কেবলমাত্র দুপুরে ভাত খেতেন। সকালে আটার জাউ আর রাতে আটার জাউয়ের সাথে সাদা মচমচে মুড়ি। এই ছিল সবচে’ বেশি বয়সী মানুষের খাদ্যাভ্যাস। এখন বৃদ্ধ বয়সে নিজের প্রজন্মরা যা খাওয়ান, তাতেই স্বাচ্ছন্দ্য পান বর্ষিয়ান নাজিম উদ্দিন খান।

যদি যেতে চান নাজিম উদ্দিন খানের বাড়ি, তবে স্মার্টফোনে গিয়ে গুগল ম্যাপকে নির্দেশনা দিন, গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা দেখিয়ে দিতে। তারপর সেখান থেকে পূর্বদিকে ১১ কিলোমিটার গেলে শ্রীপুরের রাজাবাড়ি বাজার, ঐ বাজার থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অটো রিকশা বা নিজস্ব বাহনে দেড় কিলোমিটার গেলেই (যদি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম ওঠে তবে পৃথিবীর সবচে’ বেশি বয়স্ক মানুষ) নাজিম উদ্দিন খানের মাটির ঘর।
আমাদের নাজিম উদ্দিন খান আরও দীর্ঘজীবন পান। পৃথিবীর সব সুন্দর তাঁর হোক। এই শুভাশিস থাকল। শেষবেলায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘শতবর্ষ’ বন্দনা হোক আমাদের অভিলাষঃ
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই!
শতবর্ষী নাজিম উদ্দিন খানকে নিয়ে করা টেলিভিশন রিপোর্ট এই লিংকে!
বর্ষিয়ান নাজিম উদ্দিন খানের নাম গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে উঠবে তো! রিপোর্টের ইউটিউব লিংক!

ফারদিন ফেরদৌস
লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন

No comments

Theme images by Storman. Powered by Blogger.